ফিরতে ফিরতে অনেক দেরি হয়ে গেল। এখন নৌকা পাওয়া গেলে হয়! কেন যে আবির আজ খেতে বলল? ওর সাথে খেতে খেতেই যত দেরি! যদিও বলেছিল রাতটা ওর কাছেই থেকে যাই, তবু আমার মন সায় দেয় না। বাড়িতে না হলে আমার ঘুমই হয় না।
আমি রাশেদ। একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করি। আমাদের বাসা থেকে তিন কিলোমিটার দূরে প্রতিষ্ঠান। মাঝখানে নদীপথ। তাই নৌকা নিয়ে পারাপার হতে হয়।
আজকাল মাঝিরা রাত আটটার দিকেই সব চলে যায়। এখন বাজে নয়টা। এই সময় নৌকা না পাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
তবে আমার ভাগ্য ভালো বলতে হয়। একটা নৌকা মনে হচ্ছে। ঠিকমত দেখা যাচ্ছে না। আবছা আবছা।
“এই যে কেউ কি আছেন ?” বলে ডাক দিলাম।
কিছুক্ষণ পরে অস্ফুটস্বরে জবাব এলো, “ভেতরে আসেন।”
ভয় পেয়ে গেলাম। এমনিতেই শীতের রাত। তার উপর এই একা আমি। লোকটার মুখ দেখা যাচ্ছে না। চাদর দিয়ে ঢাকা।
ভেতরে গেলাম। নৌকা চলতে শুরু করলো।
“চাচার বাড়ি কোথায়?” জিজ্ঞেস করলাম লোকটাকে।
“এইতো, নদীর ঐ পাড়েই।” জবাব দিল।
“আজকে এতো রাতেও বাড়ি যাননি। সবাই তো চলে গেছে।”
“আমি বাড়ি গেলে আপনাকে নিয়ে যেতো কে?”
“হ্যা, সেটাই তো। তবে আমার যে দেরি হবে আপনি জানলেন কিভাবে? “
“চাঁদটা আজ দেখতে সুন্দর লাগছে। দেখুন তো।”
আমি চাঁদের দিকে তাকালাম। সত্যিই সুন্দর।
‘পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।’ মনে পড়ে গেল সুকান্ত ভট্টাচার্যের সেই বিখ্যাত কবিতা।
মনে মনে কবিতাটা আবৃত্তি করলাম। নৌকা দেখি তীরে চলে এসেছে।
আমি বললাম, “কত দেব?”
লোকটা বলল, “আমি প্রতিদিনই আপনাকে নিয়ে যাবো। এখন দিতে হবে না। পরে একসময় দিবেন।”
আমিও আর কথা বাড়ালাম না। এমনিতেই অনেক রাত। তাড়াতাড়ি বাসায় যাই। সেদিন বাড়ি আসতে আসতে রাত ১০:৩০ বেজে গিয়েছিল।
পরের দিন আবার অফিসে গেলাম।
“কি ব্যাপার, রাশেদ সাহেব?” আজকে একটু তাড়াতাড়ি চলে এলেন! অফিসের বস জিজ্ঞেস করল।
“ঘুম থেকে তাড়াতাড়িই উঠেছি তো। তাই চলে আসলাম একটু আগেই।”
কম্পিউটারের সামনে বসে সব হিসাব নিকাশ করলাম। সব ফাইল চেক করলাম। সব ঠিকঠাক ই আছে৷ আরো কাজ করতে করতে বিকেল হয়ে গেল।
বিকেলে একটু চা নাস্তার ব্যবস্থা থাকে। সেই সাথে একটু বিশ্রামেরও সময় পাওয়া যায়।
চা নাস্তা শেষ করে একটু বিশ্রাম নিচ্ছি। এই সময় মোবাইল ফোনটা বেজে উঠলো।
আবির ফোন দিয়েছে। ও আমার ছোটবেলার বন্ধু। সেই ছোট থেকেই ওকে চিনি। ছোটবেলায় দুষ্টুমি করার জন্য ক্লাসে পরিচিত ছিল। তবে ওর মনে ভালো। যে কোনো প্রয়োজনে ওর সাহায্য পেয়েছি।
“কিরে, আজকেও কি বাসায় যেতে হবে?” জিজ্ঞেস করলাম ওকে।
“চলে আয় অফিস শেষে। আজকে একটু খিচুড়ি রান্না করেছি। তোর তো আবার খিচুড়ি প্রিয়।”
“দেখি, যদি কাজ তাড়াতাড়ি শেষ হয়। তবে যাবো।”
“আচ্ছা, তাড়াতাড়ি চলে আসিস।” বলে ফোনটা রাখলো আবির।
আমার অফিসের কাজ একটু তাড়াতাড়িই শেষ হলো। সন্ধ্যায় ওর বাসায় গিয়ে খিচুড়ি, ঘি, আলুভর্তা আর ডিম ভাজি খেলাম। একেবারে মনের মতো খাবার।
খাওয়া শেষ করতে বেশি সময় লাগলো না। ওর সাথে গল্প – গুজব করতে করতে বেশি রাত হয়ে গেল।
নদীর পাড়ে এসে ঘড়ির দিকে তাকালাম। রাত নয়টা। আজকেও ঐ লোকটা বসে আছে। আমি নৌকার ভেতর উঠলাম।
নৌকা যখন মাঝ নদীতে তখন লোকটা বলল, “আপনাকে জরুরি কথা বলার আছে।”
আমি বললাম, “কি কথা?”
“কথাটা বললে আপনি ভয় পাবেন। তাই নিজেকে শান্ত করুন।”
আমি বললাম, “ভয় পাব না৷ আপনি বলুন।”
লোকটা বলতে লাগলো,
“আমি ছিলাম পাশের গ্রামের স্কুলের কেরানি। স্কুলের কাজের জন্য ৫০ হাজার টাকা আমার কাছে রাখা হয়। কিন্তু কোনোভাবে খবরটা ডাকাতদের কানে চলে যায়। তারা রাতে এসে আমাকে জোর-জবরদস্তি করে টাকাটা তাদের হাতে দেয়ার জন্য। আমি কোনোভাবেই তাদেরকে বলি না৷ ফলে আমাকে ওরা মেরে ফেলে।”
আমার শরীর হিম হয়ে গেল। এতক্ষণ যার সাথে কথা বলছি সে কোনো জ্যন্ত মানুষ না। তবুও আমি যতটা সম্ভব শান্ত থাকার চেষ্টা করলাম।
লোকটা আবার বলল,
“আপনাকে একটা কাজ করতে হবে। আমি বলে দেব ঐ ৫০ হাজার টাকা কোথায় আছে। আপনি টাকাটা নিয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষকে দেবেন।”
আমি মাথা নাড়লাম। আমার কথা বলার শক্তি নেই।
নৌকা থেকে নেমে আসার সময়
লোকটা বলল, “আমাদের এটাই শেষ দেখা।”
আমি পেছন ফিরে তাকালাম না। তাড়াতাড়ি বাসায় চলে আসলাম। লোকটা কোথায় টাকা রেখেছে, সেটা বলেছে। আগামীকাল সকালে সেখানে যাবো।
স্কুল কর্তৃপক্ষকে ৫০ হাজার টাকাটা দিলাম। তারা বিভিন্ন প্রশ্ন করলো বটে। তবে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। সত্যি কথাটা বললে, এরা বিশ্বাস করবে না।